বিহারীরা কেমন আছে

Daily Inqilab সাইফুল ইসলাম শুভ

২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০৩ এএম | আপডেট: ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:১৪ এএম

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
আবুল হাশিম লিখেছেন যে, গান্ধী নোয়াখালীর গ্রামে গ্রামে ঘুরে হিন্দুদের মনোবল পুনরুজ্জীবিত করেছিলেন। গান্ধী বিহার ও পাটনা পরিদর্শন না করায় তিনি হতাশ হয়েছিলেন। এই বিষয়ে তিনি নিদারুণ দুঃখের সাথে লিখেছেন যে, ‘গান্ধীজী নোয়াখালী পরিদর্শন করায় নোয়াখালী ও কুমিল্লা জেলায় সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর মুসলিমদের নৃশংসতার উপর বিশ্বের দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়েছিল। অপরদিকে, কলকাতা ও বিহারের দাঙ্গায় সবচেয়ে বেশি নৃশংসতার শিকার হয়েছিল মুসলিমরা। কিন্তু গান্ধী কলকাতা ও পাটনায় গেলেন না।’ (আবুল হাশিম, ইন রেট্রোস্পেক্ট, বাংলাদেশ বুক কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড, চট্টগ্রাম, পৃষ্ঠা- ১৫৬)।

বিশেষ করে, মুসলিম লীগের তরুণ কর্মীরা যারা কলকাতা এবং পাটনায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় হিন্দুদের ক্ষোভ থেকে মুসলমানদের রক্ষায় বহু চেষ্টা করে গেছেন, তারা গান্ধীর উপর ক্ষুব্ধ হন। কারণ, দাঙ্গার সময় ওই দুই শহরে যেতে গান্ধী উদাসীনতা দেখিয়েছিলেন। এমন ক্ষুব্ধ তরুণ মুসলিম লীগ কর্মীদের মধ্যে একজন ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। সেসময় এক ঈদের দিনে শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার এক ফটোগ্রাফার বন্ধু মিলে নাঙ্গলডাঙ্গায় অবস্থানরত গান্ধীকে বেশ ইঙ্গিতপূর্ণ একটি উপহার দিয়েছিলেন। উপহারটি ছিল একটি প্যাকেটে মোড়া অবস্থায় কলকাতা এবং পাটনায় হিন্দুদের নৃশংসতার শিকার কিছু মুসলমানের ছবি। শেখ মুজিবের ভাষ্যমতে, ‘সেসব ছবির মধ্যে কোনোটি ছিল স্তন কেটে দেয়া মুসলমান নারীর, মস্তক বিচ্ছিন্ন শিশুর, জ্বলন্ত মসজিদের, আবার কোনোটিতে দেখা যাচ্ছিল রাস্তায় পড়ে থাকা লাশ। এরকম আরো অনেক নৃশংসতার দৃশ্য ছিল।’ গান্ধীকে এ ধরনের উপহার দেয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে শেখ মুজিবুর রহমান তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘আমরা মহাত্মাকে দেখাতে চেয়েছিলাম যে, তার সম্প্রদায়ের লোকজন কী ধরনের অপরাধ করেছে এবং কীভাবে নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করেছে।’ (শেখ মুজিবুর রহমান, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, ইউপিএল, ঢাকা, ২০১২, পৃষ্ঠা ৮৬)

শেখ মুজিবের অসমাপ্ত আত্মজীবনী থেকে আরো জানা যায়, ভারত বিভাগ পূর্ববর্তী বিহারে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা তীব্র আকার ধারণ করলে তিনি তৎকালীন মুসলিম ছাত্রলীগের প্রভাবশালী নেতা হিসেবে বিহারিদের উদ্ধারে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কলকাতা থেকে বিহারের রাজধানী পাটনায় ছুটে যান এবং আশ্রয়হীন, অসহায় ও আহত বিহারিদের পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী জেলা আসানসোলে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।

খিলাফত আন্দোলনের সময় বিহারে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক ভালো ছিল। পরে সেই সম্পর্কের অবনতি হয়। ডা. সৈয়দ মাহমুদ, অধ্যাপক আবদুল বারির মতো নেতা থাকা সত্ত্বেও কংগ্রেস ক্রমেই হয়ে উঠছিল হিন্দুর পার্টি আর মুসলিম লীগ হচ্ছিল মুসলমানের পার্টি। শুকনো বারুদ যখন স্ফুলিঙ্গের অপেক্ষায়, তখনই কলকাতা ও নোয়াখালীর দাঙ্গার খবর এসে পৌঁছায় বিহারের শহরে ও গ্রামে। বিহারের বহু মানুষ কলকাতায় কর্মরত ছিল, তারা কলকাতার দাঙ্গায় স্বজন ও সম্পত্তি হারায়। হিন্দু মহাসভা মুসলমানদের ‘অপকর্মের’ বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার আহ্বান জানায়। হিন্দু সংবাদপত্রগুলো দায়িত্বহীনভাবে উত্তেজনা বাড়ায়। ১৯৪৬ সালের ২৫ অক্টোবর কলকাতা এবং পূর্ববঙ্গের ঘটনার বিরুদ্ধে বিহারে প্রতিবাদ সভার আয়োজন করা হয়। কংগ্রেসের উদ্যোগে বিরাট বিরাট আক্রমণাত্মক মিছিল বেরোয়। দাঙ্গা লেগে যায়, আর হাজার হাজার অসহায় ও নিরস্ত্র মুসলমানের মৃত্যু হয়। ডা. মাহমুদের বিবরণ থেকে জানা যায় যে, হত্যাকা-ে, নির্যাতনে উৎখাত হয়ে সাড়ে তিন লাখ মুসলমান বাড়ি-জমি কিংবা গহনা নগণ্য দামে বিক্রি করে বিহার ছেড়েছে। তিনি নিজে একটি গ্রামে মৃত মানুষে ভরাট পাঁচটি কুয়ো দেখেন, অন্য গ্রামে দেখেন এমন আরো দশ-বারোটি কুয়ো।

এই দাঙ্গায় বিহারে শত শত বছর ধরে বসবাসকারী মুসলমান সম্প্রদায়ের অস্তিত্বের ভিত নড়ে যায়। তারা চলে আসে গ্রাম থেকে শহরে। আশ্রয় গ্রহণ করে শরণার্থী শিবিরে। পরে শুরু হয় দলে দলে বিহার ত্যাগ। ছিন্নমূলদের মুসলিম লীগ উৎসাহ দেয় বাংলায় চলে যেতে, কেননা মুসলমান শাসনাধীন বাংলাই হল তাদের পক্ষে Land of Promise.

পাঞ্জাব ও বাংলার দাঙ্গার খবর বিহারে ছড়িয়ে পড়ছিল। মুসলিম লীগ মুসলমানদের মনে পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখিয়ে বলেছিল যে, মুসলমানেরা শাসকের জাতি, তারা কোনোদিন হিন্দুর গোলামি করবে না। হিন্দুদের মধ্যেও সাম্প্রদায়িক মনোভাব তীব্র হচ্ছিল। গান্ধী বলেছিলেন, ভারতভাগ হতে দেবেন না। কিন্তু তিনিই ছিলেন ভারতভাগের অন্যতম কারিগর। মুসলিম লীগ বলেছিল, পাকিস্তান না হলে আর মুসলমানদের রক্ষা করা যাবে না। কারণ হিন্দুদের প্রস্তাব মতে, মুসলমানরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হবে! মুহম্মদ আলী জিন্নাহ একরকম বাধ্য হয়েই মুসলমানদের হিন্দু সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসীদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য ভারতভাগের দিকেই এগিয়ে গেলেন।

কংগ্রেস ২৫-২৬ অক্টোবর বিহারজুড়ে নোয়াখালী প্রতিবাদ দিবসের ডাক দেয়। রাজ্য সরকার তা সমর্থন করে। কলকাতায় ১৬ আগস্ট মুসলিম লীগের ডাকা ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসে’ সরকার ছুটি দেয়ায় দাঙ্গা ভয়ংকর চেহারা নেয় বলে আজও অবিভক্ত বাংলার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ওপর দোশারোপ করা হয়। অথচ, দুদিনের প্রতিবাদ দিবসে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী শ্রীকৃষ্ণ শাহ ও তার মন্ত্রিসভার সরাসরি সমর্থন ছিল, কিন্তু তা কখনো কোথাও কোনো নিন্দার মুখে পড়েনি। বরং বিহার জেনোসাইড নিয়ে তৎকালীন সরকারের ভূমিকা আড়াল করে রাখা হয়েছে দিনের পর দিন। এ ধরনের অর্ধসত্য ইতিহাস আজও উপমহাদেশের হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির পক্ষে বড় বাধা।

নোয়াখালী বা কলকাতা দুই জায়গায়ই ধিকিধিকি করে জ্বললেও মোটের ওপর দাঙ্গার আগুন নিভে গিয়েছিল কয়েক দিনের মধ্যে। বিহারে তা ২৫ অক্টোবর শুরু হয়ে একটানা চলেছিল ১০ নভেম্বর পর্যন্ত। এ দীর্ঘ সময়েও দাঙ্গা থামাতে মিলিটারি ডাকা হয়নি। তৎকালীন ভারতের কেন্দ্রীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু বিহারে যান ৫ নভেম্বর। তার পরপরই দাঙ্গা দমাতে মিলিটারি নামে। কিন্তু ততোদিনে অনেক দেরী হয়ে গেছে। গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংয়ের সঙ্গে সঙ্গে সেনা না নামানোয় সোহরাওয়ার্দী আজও সমালোচিত, আর প্রায় এক মাস ধরে গণহত্যা চলছে দেখেও বিহার সরকার কেন নিশ্চুপ ছিল তা নিয়ে আজও কোনো এক অজ্ঞাত কারণে কেউ প্রশ্ন তোলেন না। সে সময় কেন্দ্রীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন সরদার বল্লভভাই প্যাটেল। তার ভূমিকাও বা কী ছিল তা স্পষ্ট নয়।

ইতোমধ্যে ভারত ভাগ চূড়ান্ত হয়ে যায়। বিহার পূর্ব বাংলার লাগোয়া হওয়ায় এখানে বিহারীরা এসেছিল বেশি সংখ্যায় কিন্তু ভারতের অন্যান্য প্রদেশের বাস্তুচ্যুত মুসলমানদের অধিকাংশই ঠাঁই নিয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। বাংলাদেশে অবস্থানকারী বিহারীদের একাংশ বাংলাদেশ হওয়ার আগে-পরে পাকিস্তানে চলে গেছে। যারা এখানে রয়ে গেছে, তাদের বংশধররা এখনো ক্যাম্পবাসী। তাদের নাগরিক ও মানবিক অধিকার খর্বিত। কবে তাদের নাগরিক সমতা ও মানবিক নিরাপত্তার বিকাশ ঘটবে কে জানে! (সমাপ্ত)।

লেখক: সাধারণ সম্পাদক, নবাব সলিমুল্লাহ একাডেমী, ঢাকা।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

পিলখানা হত্যাকান্ডের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দ্ব্যর্থহীন উচ্চারণ
বিহারিরা কেমন আছে
আসাদ সরকারের পতন : নতুন সিরিয়ায় ইসরাইলি আগ্রাসন
আবাসন ও গার্মেন্ট খাতের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে
আরও

আরও পড়ুন

ব্রাজিলে বাড়ির ওপর বিমান বিধ্বস্ত, সব যাত্রী নিহত

ব্রাজিলে বাড়ির ওপর বিমান বিধ্বস্ত, সব যাত্রী নিহত

চুয়াডাঙ্গার রামদিয়ায় জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধে একজন ধারালো অস্ত্রাঘাতে হত্যা;আহত ৫

চুয়াডাঙ্গার রামদিয়ায় জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধে একজন ধারালো অস্ত্রাঘাতে হত্যা;আহত ৫

চীনের নতুন বাঁধ প্রকল্পে তিব্বতিদের প্রতিবাদ,দমন-পীড়ন ও গ্রেফতার

চীনের নতুন বাঁধ প্রকল্পে তিব্বতিদের প্রতিবাদ,দমন-পীড়ন ও গ্রেফতার

গাজীপুরে চাঁদা তোলাকে কেন্দ্র করে প্রতিপক্ষের হামলায় যুবকের মৃত্যু

গাজীপুরে চাঁদা তোলাকে কেন্দ্র করে প্রতিপক্ষের হামলায় যুবকের মৃত্যু

সউদীতে এক সপ্তাহে ২০ হাজারের বেশি প্রবাসী গ্রেপ্তার

সউদীতে এক সপ্তাহে ২০ হাজারের বেশি প্রবাসী গ্রেপ্তার

নিউইয়র্ক সাবওয়েতে নারীকে পুড়িয়ে হত্যা

নিউইয়র্ক সাবওয়েতে নারীকে পুড়িয়ে হত্যা

ঘনকুয়াশার কারণে ৭ ঘন্টা পর আরিচা-কাজিরহাট এবং পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটে ফেরি সার্ভিস চালু

ঘনকুয়াশার কারণে ৭ ঘন্টা পর আরিচা-কাজিরহাট এবং পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটে ফেরি সার্ভিস চালু

ইসরায়েলি হামলায় গাজায় নিহত আরও ৫০

ইসরায়েলি হামলায় গাজায় নিহত আরও ৫০

আওয়ামী পন্থী মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যুক্তরাজ্য শাখা বিএনপি নেতার মতবিনিময়

আওয়ামী পন্থী মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যুক্তরাজ্য শাখা বিএনপি নেতার মতবিনিময়

পরিসংখ্যান ব্যুরোর ভারপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক শরিফুলের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ

পরিসংখ্যান ব্যুরোর ভারপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক শরিফুলের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ

আ.লীগের দোসর সালাম আলী এখন বিএনপির সভাপতি প্রার্থী!

আ.লীগের দোসর সালাম আলী এখন বিএনপির সভাপতি প্রার্থী!

ঘুস নেওয়ার অভিযোগ, টিউলিপ সিদ্দিককে যুক্তরাজ্যে জিজ্ঞাসাবাদ

ঘুস নেওয়ার অভিযোগ, টিউলিপ সিদ্দিককে যুক্তরাজ্যে জিজ্ঞাসাবাদ

তালাক নিয়ে যুক্তরাজ্যে যেতে চান বাশার আল-আসাদের স্ত্রী

তালাক নিয়ে যুক্তরাজ্যে যেতে চান বাশার আল-আসাদের স্ত্রী

গভীর রাতে মেসে ছাত্রীদের বিক্ষোভ, মালিকের দুই ছেলেকে পুলিশে সোপর্দ

গভীর রাতে মেসে ছাত্রীদের বিক্ষোভ, মালিকের দুই ছেলেকে পুলিশে সোপর্দ

প্রোটিয়াদের হোয়াইট ওয়াশ করে পাকিস্তানের ইতিহাস

প্রোটিয়াদের হোয়াইট ওয়াশ করে পাকিস্তানের ইতিহাস

৯ গোলের উৎসবে লিভারপুলের বড় জয়

৯ গোলের উৎসবে লিভারপুলের বড় জয়

বড়দিনের ছুটির আগে রিয়ালের বড় জয়

বড়দিনের ছুটির আগে রিয়ালের বড় জয়

ঘরের মাঠেই বিধ্বস্ত ইউনাইটেড

ঘরের মাঠেই বিধ্বস্ত ইউনাইটেড

গোলশূন্য ড্রয়ে থামল চেলসির জয়রথ

গোলশূন্য ড্রয়ে থামল চেলসির জয়রথ

এনার্জিপ্যাকের বার্ষিক সাধারণ সভায় ব্যবসায়িক প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনার ওপর গুরুত্বারোপ

এনার্জিপ্যাকের বার্ষিক সাধারণ সভায় ব্যবসায়িক প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনার ওপর গুরুত্বারোপ